জীবন এত সহজ নয়। একটু নিরবে সুষ্ঠু মস্তিস্কে চিন্তা করলে এর সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব। প্রথমে আসি আপনি যখন এই ভূবনে আর্বিভাব হচ্ছেন তখন আপনার সাথে কেউ এসেছিল কি? আপনি নি:সন্দেহে উত্তর দিবেন কেউ আসেনি।
আপনার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে আপনাকে দেখার জন্য বহু লোক (বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন) অপেক্ষারত ছিল। তখন আপনাকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য সহযোগীতা করেছিল বিশেষ করে পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা। ধীরে ধীরে আপনি বড় হতে লাগলেন। বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য জীবন সংগ্রামে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে দিন, মাস, বছর অতিবাহিত হতে লাগলো। আপনি বিভিন্ন কিছু অবলোকন করতেছেন, চিনতেছেন, অনুভব করতেছেন। যখন সয়স ৪-৫ বছর পার হলো তখন শুরু হলো স্কুলে গমন। স্কুলে পড়া-লেখা আর পড়া -লেখা। বয়স যখন ১৫-২০ বছর তখন আপনি কিছুটা আত্ম-নির্ভশীল হতে শিখেছেন। এর আগে আপনি বাবা-মায়ের সংসারে চন্দ্রবিন্দুর মত জীবন যাপন করে অভ্যস্ত হয়ে আসছেন।
এভাবে একদিন পড়া-লেখা সমাপ্ত করে চাকুরী/ব্যবসা/অন্যকিছু করা শুরু করলেন। ইতিপূর্বে যখন আপনি স্কুলে ভাল ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন বলে আপনার বাবা-মা/ শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলে ভালবাসতেন। অপরদিকে খারাপ হলে তো বালাই নেই। অনুরুপভাবে এটা সকল কর্মক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। কোন এক সময় আপনাকে সকলে ভাল জানতো আপনি ভাল কাজ জনেন বা পারেন বলে।
পরিস্থিতির কারণে আপনি এখন তা করেন না। সেজন্য কি আপনাকে সকলে ঘৃণা করবে? বা দূরে ঠেলে দেবে? ঐ ভাল কাজের জন্য আপনাকে বহু লোক করুনা দেখাবে নিজের স্বার্থ সির্দ্ধির জন্য । এর আড়ালে যে কত ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে তা আপনি কখনও কল্পনা করতে পারবেন না। এটা প্রমাণ পাবেন তখনী যখন আপনি আপনার বিপদের সময় কোন সহায়তা চাইতে যাবেন। এজন্য মনে রাখবেন এই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। আর আপন বলতে কিছু নেই। মৃত্যুর সময়ও আপনার সাথে কেউ যাবে না। যাবে কি?
যখন অভাব দেখা দেবে তখন বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন কেউ আপনাকে চিনবে না। অভাব মোছন হলে তারা সকলে আপনাকে ঠিকই চিনবে এ হচ্ছে দুনিয়ার রীতি এবং অমোঘ বৈশিষ্ট্য। যখন আপনি কোন কাজে কৃতিত্ব/সম্মানীতে ভূষিত হয়েছেন তখন অনাত্মীয় আপনার সাথে আত্মীয়তা করতে একটুও দ্বিধাবোধ করবে না। এভাবে আপনি অনেক জ্ঞানী/গুণী জনের সাথে পরিচিত হবেন। এক সময় আপনাকে তারা খুবই ভাল জানবে। কিন্তু তাদের কাছে যখন আপনি কোন সহযোগীতা চাইবেন তখন তাদের ভালবাসা কতটুকু তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন। পাশাপাশি তাদের মন মানষিকতারও পরিচয় পাবেন অতি চমৎকারভাবে। এভাবে তারা আপনাকে বহু অফার দেবে। বড় বড় লেকচার প্রদান করবে আপনাদের এই সাহায্য করবো, এই অনুদান দেবো কিন্তু বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব আছে বলে আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই। এ সম্পর্কে অনেক লোকের উদাহরণ দেয়া যেতো। না! তাদের জাত-কুল, বংশ পরিচয়, আত্মসম্মানবোধ ক্ষুন্ন হবে বলে তা পরিহার করা হলো।
অনেকে হয়তো ভাববেন, এই সুজ মরিজ কী করতে পারবে? যখন তার অভাবের দিন ঘনিয়ে আসবে সেদিন তার কর্মবিরতি সমাপ্ত হয়ে যাবে চিরতরে। আমি মনে করি এই ধারণা আমার বেলায় প্রযোজ্য নয়। না! কখনও তা হতে দেবো না। অন্তত: এই আত্মবিশ্বাস আমার আছে । তার কারণ- আমি ছোট বেলা হতে অনেক প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে অভ্যস্ত। যেমন আপনি Discovery Channel এ এর কিছু উদাহরণ দেখে থাকবেন। সেজন্য এই ক্ষণগুলোকে আমি মহাসেন, লাইলা, সিডর এর মতে চমৎকার উদাহরণ মনে করি। যা সুজ মরিজকে কখনও ঘায়েল করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।
মাঝখানে আমার ব্যক্তিগত কারণে কর্মবিরতি নিয়েছিলাম। তাই বলে আমি চিরতরে হারিয়ে যাইনি। আমার ভাষা ও বর্ণ আমাকে বার বার রাতের আধারে হাতছানি দিয়ে পুন:রায় আমাকে জাগ্রত করতেছে। ভাবলাম আমি সবকিছু ছাড়তে পারবো কিন্তু আমার ভাষা ও বর্ণ আমাকে ছাড়বে না। এই মাতৃত্ববোধ হতে আমাকে বার বার ফিরে আনবে আপনাদের কাছে। বলতে পারেন এক ধরণের শখও বটে।
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করছে- ” তুমি ভাষা ও বর্ণের জন্য বহু ভাল কাজ করতেছ কিন্তু তোমার নাম পরিচয় কেন অন্তরালে রাখতেছে? কি তোমার লাভ? কি তোমার স্বার্থ? ” আমি উত্তরে বল্লাম – আমার ডাক নাম ” সুজ মরিজ”। আর সুজ মরিজকে সকলে চেনে আপনি কেন চিনবেন না। যে সকল কার্যক্রমে লাভ/স্বার্থ জড়িত থাকবে তা কোন ভাবেই সফল হবে না/উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। তাই আমরা এই কার্যক্রমটি আমাদের জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে শুরু করেছিলাম সম্পুর্ণ ফ্রি ও উন্মুক্ত ভাবে। যার ইচ্ছা হবে সে শিখতে পারবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কাউকে বাধ্যবাদকতা প্রয়োগ করা হবে না। আপনার যদি ভাল লাগে, মন চাই তাহলে আপনি শিখুন। আর অন্যকে শেখার জন্য অনুপ্রাণিত করুন।
এই কার্যক্রমটি করতে গিয়ে অনেক হোচট খেয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় বাধাগ্রস্থ হয়েছি। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা তা ১০০ % সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। এতে আমরা যথেষ্ট সন্তোষ্ট ও আনন্দিত। আপনি একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন-
বহু সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও সংস্থা আমাদের ভাষা ও বর্ণকে নিয়ে বহু কাল হতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের মত এত স্বল্প পরিসরে এতদূর অগ্রসর হতে পারেনি কেউ। কারণ- সেখানে সর্বদা লাভ/স্বর্থ জড়িয়ে আছে। সেখানে উন্নয়নের নামে লক্ষ, লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় কিন্তু কাজ হয় হাজার টাকা সমমানের। প্রতারণা করা হয় নিজের জাতের সাথে, লোক দেখানো কাজ ছাড়া সেখানে প্রকৃত কাজ বাস্তবে অনুপস্থিত রয়ে যায়। যার কারণে আজ আমরা এত অনগ্রসর ও পশ্চাতপদ।
এখানে শুধু সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান/এনজিও সংস্থা গুলোকে দায়ী করলে চলবে না। আমাদের নিজস্ব পারিবারিক শিক্ষাও অনেকটা দায়ী। কারণ-
ক। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণ না শিখিয়ে ২য় বা ৩য় কোন ভাষা শেখানো হয়।
খ। নিজ ভাষা ও বর্ণ সম্পর্কে অভিভাবকের ধারণা কম।
গ। ১০০% লোক নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারলেও ২-৩% লোক এ ভাষা ও বর্ণ সঠিকভাবে লিখতে ও পড়তে পারে না।
ঘ। অর্থনৈকিত দুর্বলতা।
ঙ। প্রতিকুল পরিবেশ।
আমি সকলের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করবো- আপনারা লাভ/লোকসান এর চিন্তা না করে নিজস্ব উদ্যোগে অন্তত: নিজেকে চাকমা পরিচয় প্রদানের জন্য হলেও বর্ণ সমূহ শিখুন ও অন্যকে শেখান। আমরা যতটুকু জানি এ কার্যক্রমটি সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে পরিচালনার দায়িত্ব “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট” এর। পরিশেষে বলতে চাই-
“মাননীয় চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট” এর পরিচালকগণ, UNDP, বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও মাননীয় চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়কে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি”।আপনাদের মহান উদ্যোগে ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমটি আরো অতিদ্রুত অগ্রসর হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ধন্যবাদান্তে-
Suz Moriz
ইমেইল: info@hilledu.com